প্রাণময়তার অভিঘাতে ঋদ্ধ ছোটগল্পের বহুবর্ণিল আলিম্পন

6th June 2020 বিনোদন
প্রাণময়তার অভিঘাতে ঋদ্ধ ছোটগল্পের বহুবর্ণিল আলিম্পন


                      সৌম‍্য বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

     ------------------------------------

স্নেহভাজন মানুষ বিশেষ করে অনুজপ্রতিম কারও সৃষ্টি কর্ম নিয়ে কিছু লিখতে যাওয়ার মধ্যে নিশ্চিতভাবে কিছু ঝুঁকির অবকাশ থেকেই যায় ॥ ঝুঁকিটা আলোচনার মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ছায়াপাতের । তবু সেই ঝুঁকি উপেক্ষা করে একটি ছোটগল্প সংকলন সম্পর্কে দুচার কথা বলতে এগোলাম । প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ পেশায় সরকারি কর্মী ; কিন্তু তার মনন চিন্তন জুড়ে শুধু সৃষ্টির তাগিদ । কবিতা লিখলেও প্রাণের মূল বিচরণক্ষেত্র কিন্তু কথাসাহিত্য । বিশেষ করে ছোটগল্পে তার বরাবরের টান । প্রায় বছর দশেক আগে আমি তখন একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সাহিত্য বিভাগ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলাম । সেসময় সাংবাদিকতার স্নাতকোত্তর ছাত্র প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ সেই কাগজে আমার জুনিয়র সহকর্মী হিসেবে যোগ দেয় । তখনই তার একটি নিতান্ত ছোট একটি গল্প সংকলন বেরিয়েছে । সাহিত্যের  প্রতি আগ্রহ দেখে সেকালে তাকে সাহিত্যধর্মী লেখায় উৎসাহিত  করি । চলচ্চিত্র নিয়েও খুব আগ্রহ ছিল। পরে সরকারী চাকরি করতে সে যখন গেল তখন তার সৃষ্টিশীলতার অভিমুখ নির্ধারিত হয়ে গেছে। একদা এক  চারাগাছে কিছু জলসিঞ্চনের দায়িত্ব সাহিত্যলক্ষ্মী আমাকে দিয়েছিলেন । সেই চারা আজ বেশ পোক্ত গাছ হয়ে উঠেছে । নিজের যোগ্যতাবলে আপন স্থানটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছে ।  " নাঙুলে এবং অন্যান্য গল্প " প্রাণের দ্বিতীয় গল্প সংকলন । ১২ টি গল্পের এই সংকলন হাতে নিয়ে দেখছি খুব চেনাজানা চরিত্রের ভিড় । রবীন্দ্রনাথের " সোনারতরী " কাব্যগ্রন্থের " বর্ষাযাপন " কবিতার কিছু পংক্তি ছোটগল্পের সংজ্ঞা নির্ণয়ে যুগে যুগে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । এখানেও সেই পংক্তির কিছু প্রয়োগ করা যেতে পারে। শেষের পরেও ছোটগল্পের আরও একটা শেষ থাকে । সেটা পাঠক কে কল্পনা করে নিতে হয় । " হ্যালুসিনেশন" গল্পে পৃথা ও সুজিতের সম্পর্কের মধ্যে কিছু গোপন টানাপোড়েন আছে।গল্পে  যার ইঙ্গিত রয়েছে । কিন্তু শেষে গিয়ে একটা ধাঁধার মধ্যে পড়তে হয় পাঠক কে । কে আসলে মানসিক রোগী? পৃথার নৈকট্যের অভিঘাত সুজিতকেও কি পরোক্ষ প্রভাবিত করে ফেলল? "০১৬২ " গল্প টিকে  একটা মাইক্রোথ্রিলার বলতে পারি ।মানুষ জন্ম থেকে অপরাধী হয় না । পরিস্থিতি তাকে অপরাধী করে তোলে । " ইমোশন "গল্পে নার্স যেন শোভনারই এক অলটার ইগো । তার স্বীকারোক্তির অকপট সারল্য টুকু কোথাও সদ্য সুস্থ শোভনার ওপর একটা ছায়া ফেলেছে । তাই স্বামীকে মেসেজ করার আগে তার চোখ নার্সের দিকে যায় । যে নার্স চেয়ে আছে সুদর্শন যুবকের দিকে । এইখানে একটু বলি, আমার নিজের মৌলিক লেখার চর্চা কম । সাহিত্যের অঙ্গনে আমার খেয়ালী ভ্রমণ ভিন্ন পথে । সেই পথের দীর্ঘদিনের পথিকরা বলে থাকেন -- একটি গল্পের নিবিড় পাঠের  যে আবেদন তা পাঠকভেদে সর্বদাই ভিন্ন হয় । অর্থাৎ আমি বলতে চাই প্রাণের গল্পগুলো পড়ে আমি যে স্বাদ পেয়েছি তা নিতান্তই আমার মত। পাঠক বদলে গেলে গল্পগুলোর ব্যাখ্যা  ভিন্নতর হয়ে যাবে হয়তো । "ফেরিওয়ালা " গল্পের প্রথমদিকে একটু একটু সেই কাবুলিওয়ালা কে মনে পড়লেও পরের দিকে গ্রামের সমাজের স্বঘোষিত অভিভাবকদের  চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক । শম্পার জীবনও তলিয়ে গেছে সংসারের চোরাবালিতে । "গন্তব্য " গল্পটির প্রেক্ষাপট দেখিয়ে দেয় বৈবাহিক দেনাপাওনার চোরাস্রোত আজও সমাজে বইছে । আর তার বিপরীতে আজও উদারহৃদয় যুবকের অভাব নেই । ঈশ্বরের সংজ্ঞা এক একজনের কাছে এক এক রকম । সরকারি করণিক সুগত কিভাবে মুখোপাধ্যায় দা  আর চেতনার কাছে দেবত্বে উন্নীত হল তা "ঈশ্বর" গল্পে আমরা দেখতে পাব । সুশীলবাবু একসময় সুগতর বিরোধী ছিলেন । তিনি কালের চক্রে চির ঋণী রইলেন সুগতরই কাছে । এখানে বলতে হয় প্রাণকৃষ্ণ খানিকটা স্টোরি টেলার ঘরানার গল্পকার । সে  গল্পটা বলার একটি নিজস্ব ভাষা রপ্ত করেছে । অনেক ক্ষেত্রে তা খুব গতিশীল । পাঠককে নৌকার হালে বসা মাঝির মত যেন ঘটনার স্রোতের বাঁকগুলি পার করে দিচ্ছে । ইংরাজী শব্দের বহুল ব্যবহার তার গল্পে থাকে ।  কিন্তু তা চাপিয়ে দেওয়া বলে মনে হয় না । কারণ এই ইংরাজী আমরা বহুল ব্যবহার এমনিতেই করি । সংকলনের গল্পগুলো প্রতিটির বিষয় আলাদা স্বাদের । ফলে পাঠককে একেবারেই একঘেয়েমির শিকার হতে হয় না । " ঘড়ি "গল্পতে টানটান উত্তেজনার একটা পটভূমি  আছে ; শেষাংশে বোঝা গেছে পাপের শাস্তি প্রকৃতি দেবেই । এর বেশী বলব না । বর্তমান ভারচুয়াল জগতের গভীর ছাপ রয়েছে "মধ্যবিত্ত" গল্পে ॥ এ আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিবরণ । প্রাণ এই শ্রেণীটাকে খুব ভাল চেনে , তাই যেকোন নেটিজেন এই গল্পের সঙ্গে একাত্ম হতে পারবেন । মিষ্টি প্রেমের পরিণতি রাজনীতির কারণে কত কত ট্র্যাজিক হতে পারে তার উদাহরণ "প্রেম যখন" গল্প । রোহিত কি নিজের জীবন দিয়ে অন্য এক যুবক কে বাঁচালো ? প্রশ্ন টা তোলা থাক । "সবকিছুই" গল্পটি যেন আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজকে এক আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল । সুচরিতার সঙ্গে দেখা হলে তার চোখের দিকে তাকাতে পারব তো ? "উইনিং স্ট্রোক" গল্পে জীবনের বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলের মাধ্যম হয়েছে ক্রিকেটের পরিভাষা । টাইমিং আমাদের অনেকেরই ভুল হয় বটে । বইয়ের শুরুতেই আছে "নাঙুলে" গল্পটি। বিশুদ্ধ গ্রামের ভাষায় গল্পটি লিখেছে প্রাণকৃষ্ণ ॥

৬০ পৃষ্ঠার বইটি শব্দসাঁকোর পক্ষে প্রকাশ করেছেন সৌরভ বিশাই । বড় হরফে ছাপা বইটির মুদ্রণ পারিপাট্য চমৎকার । সন্তু কর্মকারের প্রচ্ছদ বইটির আকর্ষণ বাড়িয়েছে । বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অজিতেশ নাগের লেখা ভূমিকাটি বারবার পড়ার মত । বইটির মূল্য ১০০ টাকা ।





Others News

ফিরে এসো অপু - আকুল প্রার্থনায় আপামর বাঙালী

ফিরে এসো অপু - আকুল প্রার্থনায় আপামর বাঙালী


                    সৌম‍্য ঋষি 

----------------------------------------

আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, গভীর রাতে বা ভোরবেলা ফোন বাজলেই চমকে ওঠেন। আবার কারও মৃত্যু সংবাদ এল কি?  এবার কার পালা! 
রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, "আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা নিশীথবেলা।" তেমনই আপনার কন্ঠে -" মৃত্যু আয় তিনপাত্তি খেলি"- অমর হয়ে থাকবে। যদিও আপনি লেখেননি, তবু যেন এটা আপনার। আপনার মনের কথাগুলি যেন অনেকদিন বাদে বললেন। আপনার সাদাকালো সিনেমা দেখে যেই প্রজন্ম বড় হয়েছেন তাদের মনে সবসময় আপনাকে আর উত্তম কুমারকে নিয়ে একটা তুলনা চলত। কিন্তু তারাও আপনার অভিনয়ের, কন্ঠের ভক্ত। অথচ বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রথম পছন্দ ছিলেন আপনি।  আমরা যারা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দিকে চলেছি এবং প্রতিনিয়ত আপনার নতুন নতুন কাজ দেখছি, তারা আপনার আকুল ভক্ত। ছোট ছোট বাজেটের ছবি, আর তাতে আপনার উপস্থিতি ছবিটিকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়।  আমরা অপুকে চিনি, ফেলুদাকে চিনি, জীবনে কি পাব না গানের সাথে নৃত্যরত সেই অভিনেতাকে যেমন চিনি, তেমন চিনি সেই অগ্রদানী ব্রাহ্মণকে - যার অসহায়তা চোখের জল ধরে রাখতে দেয় না - আবার কুন্তল কেও চিনি, পোস্তর দাদুকে চিনি, বেলাশেষের সেই বৃদ্ধকে চিনি, ধর্ষিতা নাতনির হয়ে বদলা নেওয়া ইঞ্জিনিয়ার  দাদুকে চিনি। পর্দায় আপনার সৌম্যদর্শন চেহারা, বিরামহীন এই কর্মজীবন শুধু আমাদের নয়, আমাদের পরের প্রজন্মকেও আপনার ডাই হার্ট ফ্যান করে তুলেছে। আজ মৃত্যু আপনার কাছে একটি আবশ্যিক ঘটনার মতো। রেখাপাত করার মতো নয়।  কারণ আপনি লিজেন্ড।  আমরা আপনাকে চিনি আপনার কাজ দিয়ে। যা আপনাকে চিরজীবী করবে। ব্যাক্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কেমন থাকেন, তাঁর নিজস্ব দুঃখ সুখ,তাঁর জীবনটা কি আমাদের মতোই সাধারণ না রূপকথার মতো - জানি না কিছুই। আপনি এই অসাধ্যসাধনটি করতে পেরেছেন। আমরা ঋদ্ধ হয়েছি আপনার কাজে। প্রণম্য আপনি। সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। না হয় আপাতত কাজ নাই করলেন। তবু জানব আছেন। আর যদি মৃত্যু আপনাকে ডেকে নেয়, তার কারণ অন্য হোক। করোনায় মরণ আপনার জন্য কাম্য না। কক্ষোনো না কক্ষোনো না ----

ছবি : সংগৃহিত